ভালোবাসাটা তবে গেলো কোথায়

প্রেমের লুপ্তপ্রায় রূপ ও তার বিবর্তন যা ছিল, তবে  এখন পুরোদস্তুর অতীত 

প্রেমটা যেন বিদ্রুপ করতে করতে হারিয়ে যাচ্ছে অতল থেকে অতলে। এই কথাটি যখন আমার মনে প্রথম উদিত হয়, তখন মনে হয় যেন এক অদৃশ্য তরঙ্গে ভেসে যাচ্ছে মানুষের হৃদয়ের সেই পবিত্র, স্নিগ্ধ অনুভূতি, যা একদিন ছিল জীবনের মূল সুর, সম্পর্কের প্রাণশক্তি। প্রেম, যা একদিন কবি রবীন্দ্রনাথের কলমে ছিল “হৃদয়ের কোমলতম স্পন্দন”, আজ তা যেন স্ক্রিনের নীলাভ আলোয় বন্দী হয়ে ক্রমশ যান্ত্রিকতার দাসত্বে নিমজ্জিত। এই প্রবন্ধে আমরা প্রেমের এই বিবর্তনের গভীর বিশ্লেষণ করব, তার পূর্বেকার রূপ থেকে বর্তমানের যান্ত্রিক আবরণ পর্যন্ত, এবং এর মধ্যে কীভাবে মানুষের হৃদয়ের সূক্ষ্মতা হারিয়ে যাচ্ছে তা তুলে ধরব। এই বিশ্লেষণে আমরা প্রেমের সংজ্ঞা, তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, এবং আধুনিকতার প্রভাবে তার রূপান্তরের বিষয়ে আলোচনা করব, যেখানে পুরনো বাঙালি চিন্তাবিদদের ভাবনা ও উদ্ধৃতি আমাদের পথপ্রদর্শক হবে।

প্রেম, একদিন ছিল হৃদয়ের গভীরতম স্তরে সঞ্চারিত এক অলৌকিক শক্তি। বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে প্রেম ছিল সাহিত্য, কবিতা, গান ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি পবিত্র উপাদান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় বলেছেন, “প্রেম যেখানে গভীর, সেখানে মিলনের আনন্দও গভীর।” এই প্রেম ছিল সেই সময়ের, যখন একটি হাতে লেখা চিঠি মনের গভীরতম কথা বহন করতো, যখন একটি দৃষ্টি বিনিময়ে হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি প্রকাশ পেত। আমার বর্ণনায় উল্লিখিত বাবু ও মায়ের সম্পর্কের উদাহরণটি এই পুরনো প্রেমের একটি জীবন্ত ছবি। তাঁদের মধ্যে তুমুল কথা কাটাকাটি হলেও, পরদিন সকালে বাবু বাঁধাকপি কেটে মাকে সাহায্য করতেন। এই ছোট্ট কাজের মধ্যে লুকিয়ে ছিল একটি অকথিত প্রেম, যা কোনো শব্দের প্রয়োজন ছাড়াই নিজেকে প্রকাশ করত। এই প্রেম ছিল সহজ, স্বাভাবিক, এবং হৃদয়ের গভীরতা থেকে উৎসারিত।

বাংলা প্রবন্ধ: প্রেমের বিবর্তন এবং আধুনিক সম্পর্কের যান্ত্রিকতা


বাঙালি দার্শনিক ও সমাজচিন্তক বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “প্রেম হলো সেই শক্তি, যা মানুষকে অসীমের দিকে নিয়ে যায়।” তাঁর এই উক্তি প্রেমের সেই রূপকে তুলে ধরে, যা কেবল দুই ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক সংযোগ, যা জীবনকে অর্থপূর্ণ করে। পূর্বের যুগে প্রেম ছিল ধৈর্যের, ত্যাগের, এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার একটি প্রতীক। এই প্রেমের মধ্যে ছিল একটি গভীর বিশ্বাস, যা সম্পর্ককে দৃঢ় করত।

কিন্তু আজকাল প্রেমটা যেন লাল, নীল, সবুজের স্ক্রিনের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। আধুনিকতার এই যুগে প্রমের সংজ্ঞা বদলে গেছে। প্রেম এখন আর হাতে লেখা চিঠির মাধ্যমে প্রকাশ পায় না, বরং ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপের নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ। এই যান্ত্রিক প্রেম যেন একটি যন্ত্রের মতো—চালালে চলে, না চালালে বন্ধ হয়ে পড়ে অযাচিত কোণে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর একটি কবিতায় বলেছিলেন, “হৃদয়ের গান যদি থামে, তবে জীবনও থেমে যায়।” কিন্তু আজকের প্রেম যেন সেই হৃদয়ের গানকে ভুলে গেছে, এবং তার স্থান দখল করেছে ডিজিটাল যুগের কৃত্রিম সুর।

আমার বান্ধবীর উদাহরণটি এই বিষয়ে একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। তার প্রেমিক, যিনি বাহ্যিকভাবে সব দিক থেকে “উপযুক্ত”—দেখতে ভালো, অভিজাত পরিবারের, শিক্ষিত, ভদ্র, এবং তার প্রতি যত্নশীল—তবুও তার প্রতি বান্ধবীর মনে একটি অব্যক্ত অরুচি তৈরি হয়েছে। এই অরুচির কোনো সুস্পষ্ট কারণ নেই, কিন্তু এটি একটি গভীর সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে। আধুনিক প্রেম যেন আর হৃদয়ের গভীরতা থেকে উৎসারিত নয়, বরং এটি একটি নৈব্যক্তিক প্রতিযোগিতার অংশ হয়ে উঠেছে। বান্ধবী তার প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারছে না, কারণ সে তাকে দুঃখ দিতে চায় না। কিন্তু এই সম্পর্ক এখন কেবল ফর্মালিটির জন্য টিকে আছে। এই ফর্মালিটির পেছনে কি প্রকৃত প্রেম আছে, নাকি এটি কেবল একটি সামাজিক বাধ্যবাধকতা?

আধুনিক যুগে প্রেমের এই যান্ত্রিক রূপান্তরের পেছনে প্রযুক্তির ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। একদিন যে প্রেম ছিল হাতে লেখা চিঠির মাধ্যমে প্রকাশিত, তা আজ মুহূর্তের মধ্যে ডিলিট করা যায় এমন টেক্সট মেসেজে রূপান্তরিত হয়েছে। এই যান্ত্রিকতা প্রেমকে আরও নৈব্যক্তিক করে তুলেছে। বাঙালি দার্শনিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর লেখায় বলেছিলেন, “প্রেম হলো সেই আগুন, যা হৃদয়কে জ্বালিয়ে দেয়, কিন্তু তাকে ধ্বংস করে না।” কিন্তু আজকের প্রেম যেন সেই আগুন হারিয়ে ফেলেছে। এটি এখন একটি অ্যালগরিদমের মতো, যা সামাজিক মাধ্যমের লাইক, কমেন্ট, এবং শেয়ারের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

আধুনিক প্রেমের এই নৈব্যক্তিকতা আমাদের সম্পর্কের গভীরতাকে ক্ষয় করছে। আমার বান্ধবীর গল্পে আমরা দেখতে পাই, তার প্রেমিকের প্রতি তার মন উঠে গেছে, কিন্তু সে তাকে ছেড়ে দেওয়ার সাহসও পাচ্ছে না। এই দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে আধুনিক সমাজের চাপ—যেখানে সম্পর্ক একটি সামাজিক প্রদর্শনের অংশ হয়ে উঠেছে। ফেসবুকের “ইন এ রিলেশনশিপ” স্ট্যাটাস বা ইনস্টাগ্রামে একসঙ্গে ছবি পোস্ট করা যেন প্রেমের প্রমাণ। কিন্তু এই প্রদর্শনের পেছনে প্রকৃত অনুভূতির অভাব থাকলে, তা কি সত্যিই প্রেম?

প্রেমের অর্থ যেন লুপ্তপ্রায়। এই লুপ্তপ্রায়তার মধ্যে আমরা দেখতে পাই একটি গভীর শূন্যতা। আধুনিক সমাজে প্রেম আর একটি আত্মিক সংযোগ নয়, বরং এটি একটি পণ্যের মতো হয়ে উঠেছে, যা কেনা-বেচা করা যায়, বেছে নেওয়া যায়, এবং পরিবর্তন করা যায়। ডেটিং অ্যাপের যুগে প্রেম যেন একটি ক্যাটালগ থেকে পণ্য বাছাইয়ের মতো। সোয়াইপ লেফট, সোয়াইপ রাইট—এই সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রেমের গভীরতা হারিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “প্রেমের মধ্যে আছে একটি অসীম রহস্য, যা কখনো পুরোপুরি বোঝা যায় না।” কিন্তু আজকের প্রেম যেন সেই রহস্য হারিয়ে ফেলেছে। এটি এখন একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যেখানে অনুভূতির চেয়ে সুবিধা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আমার বান্ধবীর গল্পে এই শূন্যতা স্পষ্ট। তার প্রেমিকের প্রতি তার কোনো অভিযোগ নেই, তবুও তার মন তাকে গ্রহণ করতে পারছে না। এই অরুচির পেছনে কি কেবল তার নিজের দোষ? নাকি এটি আধুনিক প্রেমের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য? আমরা যখন প্রেমকে একটি পণ্যের মতো দেখতে শুরু করি, তখন এটি আর প্রেম থাকে না। এটি হয়ে ওঠে একটি লেনদেন, যেখানে আমরা কেবল নিজের সুবিধা ও সুখের কথা ভাবি।

আমরা যখন পুরনো প্রেমের কথা ভাবি, তখন মনে পড়ে সেই দিনগুলো, যখন প্রেম ছিল বইয়ের পাতায় ভাঁজে ভাঁজে গাঁথা। একটি হাতে লেখা চিঠি, একটি কবিতা, বা একটি গানের মাধ্যমে প্রেম প্রকাশ পেত। সেই প্রেম ছিল ধীর, গভীর, এবং অর্থপূর্ণ। কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বলেছিলেন, “প্রেমের মধ্যে আছে একটি নিস্তব্ধতা, যা কেবল হৃদয় দিয়েই শোনা যায়।” কিন্তু আজকের প্রেমে সেই নিস্তব্ধতা নেই। এটি এখন একটি কোলাহল, যেখানে সামাজিক মাধ্যমের নোটিফিকেশনের শব্দ প্রেমের কথাকে ছাপিয়ে যায়।

আমরা কি সত্যিই প্রেমকে হারিয়ে ফেলেছি? নাকি এটি এখনো চোরাবালির মধ্যে থেকে হাত বাড়াচ্ছে, কেউ বা কারা যেন তাকে আবার উদ্ধার করে আনবে? এই প্রশ্নটি আমাদের মনে একটি গভীর অস্থিরতা সৃষ্টি করে। আমরা হয়তো আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে প্রেমের সেই পুরনো রূপটিকে হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু এই হারানোর মধ্যেও আছে একটি আশা—যে প্রেম আবার ফিরে আসবে, হয়তো অন্য রূপে, কিন্তু তার মূল সত্তা অক্ষুণ্ণ থাকবে।

প্রেমের এই বিবর্তন আমাদেরকে একটি গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি করে। আমরা কি সত্যিই প্রেমকে হারিয়ে ফেলেছি, নাকি এটি কেবল রূপ বদলেছে? আধুনিক যুগে প্রেম যেন একটি দ্রুতগামী ট্রেন, যা আমরা ধরতে চাই, কিন্তু তার গতি আমাদের হৃদয়ের ধীর লয়ের সঙ্গে মেলে না। রবীন্দ্রনাথের কথায়, “প্রেম হলো সেই সুর, যা হৃদয়ের তন্ত্রীতে বেজে ওঠে।” আমাদের দায়িত্ব হলো সেই সুরকে আবার খুঁজে পাওয়া, যান্ত্রিকতার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সেই হৃদয়ের স্পন্দনকে পুনরুদ্ধার করা।

আমার বান্ধবীর গল্প, বাবু ও মায়ের সম্পর্ক, এবং আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রেম কখনো পুরোপুরি হারায় না। এটি হয়তো চোরাবালির মধ্যে লুকিয়ে থাকে, কিন্তু সঠিক সময়ে, সঠিক মানুষের হাতে এটি আবার জেগে ওঠে। আমাদের প্রয়োজন কেবল সেই ধৈর্য, সেই বিশ্বাস, এবং সেই হৃদয়, যা প্রেমকে আবার তার পূর্ণ রূপে ফিরিয়ে আনতে পারে।   


- সঞ্জয় বিশ্বাস। 

Previous Post Next Post

Contact Form